এবার টার্গেট পাকিস্তান!

এবার টার্গেট পাকিস্তান!
পাকিস্তানের ক্ষেপনাস্ত্র মহড়া ছবি: সংগৃহীত

পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ গত মাসে সতর্ক করে বলেছিলেন, মুসলিম দেশগুলোকে অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, নাহলে ‘সবার পালা আসবে’। তাঁর এই বক্তব্য যতটা না কূটনৈতিক আক্ষেপ, তার চেয়ে বেশি সতর্কতা সংকেত।

গত মাসে ইসরায়েল ইরানে হামলা চালায়। পশ্চিমা নেতারা ও গণমাধ্যম বাস্তবতাকে উল্টে দিয়ে ইরানকেই হুমকি হিসেবে ঘোষণা করে। এ ঘটনায় যে গা হিম করা প্রশ্ন উঠে এল, তা হলো, এবার কার পালা?

‘বৈশ্বিক নিরাপত্তা’র নামে দশকের পর দশক ধরে একের পর এক দেশকে যেভাবে শয়তান ও অবৈধ তকমা দিয়ে নিশ্চিহ্ন করার ঘটনা ঘটে চলছে, তাতে বিষয়টিকে উপেক্ষা করা যায় না।

পশ্চিমের এখন আর জাতিসংঘের প্রস্তাবের প্রয়োজন পড়ে না। তাদের সামনে নতুন কৌশল চলে এসেছে। বর্তমানে একটি দেশের সার্বভৌমত্ব ধ্বংস করে দেওয়া হয় সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম, অর্থনৈতিক অবরোধ ও বয়ান নির্মাণের যুদ্ধের মাধ্যমে। সেটা যদি ব্যর্থ হয়, তাতে সমস্যা নেই। ইসরায়েল যেভাবে আগাম ধারণার বশবর্তী হয়ে ইরানের ওপর হামলা করেছে, সেভাবে হামলার ন্যায্যতা তৈরি করা যাবে।

এবারে অন্তত ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে একটা কৃতিত্ব দেওয়া যেতেই পারে। তিনি মুখ ফসকে সত্যটা বলে দিয়েছেন। দশকের পর দশক ধরে তিনি সতর্ক করে আসছিলেন যে বেয়ারা মুসলিম দেশগুলোর শাসকেরা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা অর্জন করতে পারেন। এর আগে ইরাককে বোমা মেরে ধ্বংস করা হয়েছে। লিবিয়াকে নিরস্ত্র করা হয়েছে। এখন ইরানকে গলা চেপে হত্যার চেষ্টা করা হচ্ছে।

আর পাকিস্তান? এটাই শেষ সীমান্ত, তা এই কারণে নয় যে পাকিস্তান সবাইকে আক্রমণ করেছে, বরং এই কারণে যে পশ্চিমা ও জায়নবাদী আধিপত্যের বিরুদ্ধে পাকিস্তান কৌশলগত, মতাদর্শগত ও প্রযুক্তিগত প্রতিরোধের প্রতীক।

এই যুক্তি এখন ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। সম্প্রতি ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়ার একটি প্রতিবেদন ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, পাকিস্তান এমন আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করছে, যেটা যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম। কোনো নিশ্চিত প্রমাণের দরকার নেই; শুধু ইঙ্গিতই সন্দেহ ছড়ানোর জন্য যথেষ্ট।

এটা ২০০১ সাল নয়। এখন আর কেউ স্যাটেলাইট থেকে তোলা ঝাপসা ছবি দিয়ে ‘ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্রের গল্প’ বানিয়ে বিক্রি করে না। কিন্তু উদ্দেশ্যটা সেই একই রয়ে গেছে। পাকিস্তানের পারমাণবিক সক্ষমতাকে এমনভাবে তুলে ধরা হচ্ছে যেন এটা একটা বৈশ্বিক বোঝা।

ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড ও নিরাপত্তাবিষয়ক থিঙ্কট্যাংকগুলো এখন নিয়মিতই পাকিস্তানকে একটি অস্থিতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে বর্ণনা করছে, যে রাষ্ট্র উগ্রবাদের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু করার জন্য মুখিয়ে আছে।

ডেইলি মেইলের একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে সেই ক্লিশে বয়ান আবার দেখা গেল। পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব নাকি যুক্তিসঙ্গত কারণে নয়, ধর্মীয় উন্মাদনার বশবর্তী হয়ে ভারতের সঙ্গে সংঘর্ষের কিনারে পৌঁছে গেছে। একজন ভারতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষকের বরাতে সেখানে বলা হয়েছে, পাকিস্তান উগ্রপন্থী ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে।

এ ধরনের অভিযোগ যে কতটা ফাঁপা, সেটা এই অঞ্চল সম্পর্কে যাঁর ন্যূনতম জ্ঞান আছে, তাঁর পক্ষে বোঝাটা যথেষ্ট। নানা সংকট থাকা সত্ত্বেও গত সাত দশকের বেশি সময়ে পাকিস্তান কখনোই কোনো ধর্মভিত্তিক দলকে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আনেনি। ভোটাররা সব সময় ব্যালটের মাধ্যমে ধর্মতন্ত্রকে প্রত্যাখ্যান করে এসেছেন।

অন্যদিকে ভারত এমন একজনকে উৎসাহের সঙ্গে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছে, যিনি ২০০২ সালে গুজরাট গণহত্যার সময় সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। অভিযোগ আছে যে তিনি সে সময় চোখ বন্ধ করে রেখেছিলেন। সেই ব্যক্তি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, এখন এমন একটি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যে দল প্রকাশ্যেই একটি হিন্দু জাতীয়তাভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের কথা বলে, যেখানে মুসলমান ও অন্য সংখ্যালঘুদের প্রান্তিক করে তোলা হবে।

এরপরও ব্রিটিশ ও পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের একটা বড় অংশ ভারতকে এখনো যুক্তিবাদনির্ভর রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রের বাতিঘর হিসেবে দেখে। এই দ্বিচারিতাকে হাস্যকর বলা যেত যদি সেটা বিপদজ্জনক না হতো।

গত এপ্রিলে পেহেলগামে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের ওপর ট্র্যাজিক হামলার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহকে বিবেচনায় নেওয়া যাক। সেই ঘটনায় পাকিস্তানের সম্পৃক্ততার কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ না দিয়েই সীমান্ত পার হয়ে সামরিক অভিযান শুরু করে ভারত।

পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম অনেকটাই দিল্লির বয়ানকে প্রশ্নহীনভাবে গ্রহণ করে। এর বিপরীতে পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের বৈরিতাপূর্ণ সাক্ষাৎকারের মুখোমুখি হতে হয়। সন্ত্রাসবাদ ইস্যুতে তাঁদের আবারও কাঠগড়ায় তোলা হয়। এই চিত্রায়ন হতাশাজনকভাবে নিয়মিত চিত্রে পরিণত হয়েছে।

এখানে একটা অঘোষিত ও অব্যর্থ যুক্তি আছে। সেটা হলো, হিন্দু জাতীয়তবাদী রাজনীতি, সেটা যতই সহিংস হোক না কেন, সেটাকে কারও রাজনৈতিক পছন্দ হিসেবে চিত্রায়িত করা হবে। অর্থাৎ, পরিতাপ করার মতো বিষয় হলেও, সেটা বৈধ। ইসলামপন্থী রাজনীতি, সেটা ক্ষমতার ধারেকাছে না থাকলেও, সেটাকে অস্তিত্বগত হুমকি হিসেবে দেখা হবে।

পাকিস্তান বিষয়ে পশ্চিমা সমস্যাটা আসলে দেশটি যা করছে তার জন্য নয়। বরং পাকিস্তান যেসব বিষয়ের প্রতিনিধিত্ব করে, তার জন্য। পাকিস্তান একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্র, একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ এবং চীনের মিত্র। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় এই তিনের সম্মিলন হলো চূড়ান্ত বিপৎসীমা।

মিডলইস্ট আই থেকে অনুবাদ