এবার কি আলোর মুখ দেখবে ‘মুসলিম ন্যাটো’

 এবার কি আলোর মুখ দেখবে ‘মুসলিম ন্যাটো’
দোহা, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, কাতারে আরব-ইসলামিক নেতাদের জরুরি সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা। ছবি: সংগৃহীত

গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেওয়া প্রস্তাব নিয়ে কাতারের দোহায় আলোচনায় বসেন হামাসের নেতারা। এ সময় একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানতে শুরু করে দোহার আবাসিক এলাকায় হামাস নেতাদের ভবনে। কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উড়তে দেখা যায় দোহার আকাশে।

অবশ্য ৯ সেপ্টেম্বরে ওই হামলা থেকে অল্পের জন্য বেঁচে যান দোহায় অবস্থানরত হামাসের রাজনৈতিক শাখার নেতারা। এতে নিহত হন হামাসের শীর্ষ নেতা খলিল আল-হায়ার ছেলেসহ পাঁচজন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে কাতারের একজন নিরাপত্তাকর্মীও রয়েছেন। বাকিরা হামাস নেতাদের নিরাপত্তারক্ষী।

কাতারে ইসরায়েলের এই হামলার পর নড়রচড়ে বসেছে উপসাগরীয় আরব দেশগুলো। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাতারের কৌশলগত সম্পর্ক থাকার পর ইসরায়েলের এমন ‘স্পর্ধা’ হজম করা কঠিন হয়ে উঠেছে উপসাগরীয় নেতাদের জন্য। বিশেষ করে হামলার আগে ইসরায়েল বিষয়টি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে জানিয়েছেন, এমন খবর প্রকাশ্যে আসার পর আরব নেতারা ‘বিকল্প’ চিন্তা করতে শুরু করেছেন, এমন গুঞ্জন উঠেছে।

ইসরায়েলের হামলায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায় কাতার। ১৫ সেপ্টেম্বর দোহায় ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) ও উপসাগরীয় সহযোগিতা সংস্থার (জিসিসি) জরুরি সম্মেলন আহ্বান করা হয়। সেখানে প্রায় ৬০টি দেশের নেতা ও কর্মকর্তারা অংশ নেন। বেশির ভাগ নেতাই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সম্মিলিত ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেন।

ছয় আরব দেশের সমন্বয়ে গঠিত জিসিসি জোটের বৈঠকে নেতারা যৌথ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সচলের ঘোষণা দেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯ সেপ্টেম্বর জোটটির যৌথ প্রতিরক্ষা কাউন্সিল দোহায় এক বিশেষ অধিবেশনে যেকোনো ধরনের বিদেশি হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষামূলক যৌথ ব্যবস্থা নিতে সম্মত হয়।

এ ছাড়া সৌদি আরব ও পাকিস্তান ১৭ সেপ্টেম্বর ‘কৌশলগত যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তি’ সই করলে নতুন করে পালে হাওয়া পায় ‘আরব ন্যাটো’ বা ‘মুসলিম ন্যাটো’ ধারণাটি।

আরব ন্যাটো কি নতুন ধারণা

যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর ৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো সদস্যদেশ হামলার শিকার হলে, এটিকে সব দেশের হামলা হিসেবে ধরে নেওয়া হবে। একই সঙ্গে সব সদস্যদেশ মিলে এর জবাব দেবে। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার বাইরে এই জোটের বেশির ভাগ দেশে ইউরোপ মহাদেশের।

কাতারে ইসরায়েলে হামলার পর ন্যাটোর আদলে আরব ন্যাটো বা মুসলিম ন্যাটো ধারণাটি আবার সামনে এসেছে। মিসরের সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল নিউজ জানিয়েছে, কাতারে হামলার পরিপ্রেক্ষিতে মিসরের পক্ষ থেকে ‘আরব সামরিক জোট’-এর প্রস্তাব দিয়েছে কায়রো। এ ছাড়া ওআইসির সম্মেলনে ইরাকের পক্ষ থেকে মুসলিম ন্যাটো গঠনের প্রস্তাব এসেছে।

এর আগে ২০১৫ সালে মিসরের পর্যটন নগরী শার্ম আল-শেখে অনুষ্ঠিত আরব শীর্ষ সম্মেলনে দেশটি প্রথম ন্যাটো ধাঁচের একটি ঐক্যবদ্ধ সামরিক বাহিনী গঠনের প্রস্তাব পেশ করে। নীতিগতভাবে এটি তখন গৃহীত হয়েছিল।

তবে পরবর্তী বৈঠকে এ নিয়ে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি বলে জানা গেছে। কারণ, বাহিনীর কমান্ড কাঠামো এবং সদর দপ্তর কোথায় হবে, তা নিয়ে মতপার্থক্য ছিল।

ওই সময় ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা ইয়েমেনের বিশাল এলাকা দখল করে নিলে মিসর খসড়া আকারে প্রস্তাবটি দিয়েছিল। যদিও ইয়েমেনের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকারের পক্ষে লড়াই করতে তখন সৌদি নেতৃত্বে একটি জোট গঠন করা হয়েছিল।

নিজের প্রথম মেয়াদে ইরানকে লক্ষ্য রেখে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও আরব সামরিক জোট গঠনের চেষ্টা চালিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র ও আরব কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ২০১৮ সালের জুলাইয়ে এক প্রতিবেদনে রয়টার্স বলেছিল, ট্রাম্প প্রশাসন গোপনে একটি নতুন নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক জোট গঠনের উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এই জোটে ছয়টি উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্র, মিসর ও জর্ডানকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এই উদ্যোগের একটি প্রধান উদ্দেশ্য হলো মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব প্রতিহত করা।

চারটি সূত্রের বরাত দিয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, হোয়াইট হাউস চাইছে, দেশগুলোর মধ্যে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা, সামরিক প্রশিক্ষণ, সন্ত্রাস দমন এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার মতো অন্যান্য বিষয়ে সহযোগিতা আরও গভীর হোক। হোয়াইট হাউস ও মধ্যপ্রাচ্যের কর্মকর্তারা এই পরিকল্পনাকে তখন আরব ন্যাটো নামে অভিহিত করেছিলেন।

হোয়াইট হাউস এই জোটের ধারণা নিয়ে কাজ করার বিষয়টি তখন নিশ্চিত করেছিল। তারা বলেছিল, ‘কয়েক মাস ধরে আমাদের আঞ্চলিক অংশীদারদের সঙ্গে’ এই জোট গঠনের ধারণা নিয়ে কাজ করছে তারা।

মিডল ইস্ট আই-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, জিসিসির সদস্যদেশগুলো ২০০০ সালে একটি যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। চুক্তিতে বলা হয়েছে, একটি সদস্যরাষ্ট্রের ওপর হামলা মানেই, সবার ওপর হামলা।

সম্প্রতি জিসিসি ঘোষণা করেছে, তারা সহোদর রাষ্ট্র কাতারকে সমর্থন জানাতে এবং যেকোনো হুমকি থেকে এর নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে সব ধরনের সক্ষমতা কাজে লাগাতে প্রস্তুত।

তবে জিসিসির এই আত্মরক্ষার অঙ্গীকার ন্যাটো সামরিক জোটের মতো অতটা কঠোর ও সুসংগঠিত নয়। কারণ, জোটটির কোনো সুসংহত সামরিক কমান্ড কাঠামো নেই। অতীতে সদস্যদেশগুলোর ওপর হামলা, যেমন সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের ওপর হুতিদের হামলার পর জিসিসি সম্মিলিতভাবে কোনো সামরিক পদক্ষেপ নেয়নি।

অবশ্য বর্তমানে উপসাগরীয় নেতারা লেবানন, সিরিয়া ও ইরানের প্রতি ইসরায়েলের যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে আগে থেকেই গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।

পাশাপাশি গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যার কারণেও এসব দেশের জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে। ইসরায়েলের হামলার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ঔদাসীন্য উপসাগরীয় দেশগুলোকে মর্মাহত করেছে।

আরব ন্যাটোর সম্ভাবনা কতটুকু

সৌদি আরব ও পাকিস্তানের যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তির পর আরব ন্যাটো বা মুসলিম ন্যাটোর ধারণা নিয়ে জোর গুঞ্জন শুরু হয়েছে। বিশেষ করে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের বক্তব্যের পর বহুপক্ষীয় একটি সামরিক জোট গঠনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

লন্ডন সফরে ইসহাক দার সাংবাদিকদের ইঙ্গিত দেন, আরও কিছু দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে কৌশলগত প্রতিরক্ষা চুক্তি তৈরিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং কাতারও এ ধরনের চুক্তি করতে পারে।

এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের আগ্রাসী আচরণ নতুন করে ভাবাচ্ছে আরব শাসকদের। ‘গ্রেটার ইসরায়েল’ বাস্তবায়নের কথা জোর গলায় বলছে ইসরায়েলের ডানপন্থী রাজনীতিকেরা।

কল্পিত এই ‘গ্রেটার ইসরায়েলের’ মধ্যে পড়েছে ফিলিস্তিন, লেবানন, সিরিয়া ও জর্ডানের মতো দেশের ভূখণ্ড। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের ‘চেহারা বদলে দেওয়ার’ ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর হুমকিকে খাটো চোখে দেখছে না উপসাগরীয় দেশগুলো।

‘গ্রেটার ইসরায়েল’ ধারণার বড় সমর্থক যুক্তরাষ্ট্রের জায়নবাদী খ্রিষ্টানরা। দেশটির বড় এই জনগোষ্ঠীর মতের বাইরে গিয়ে কোনো সরকারের আরবদের পাশে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। সে ক্ষেত্রে বিকল্প উপায় খুঁজে বের করার বিকল্প নেই আরব শাসকদের সামনে।

বৃহত্তর ইসরায়েল মানচিত্র নিয়ে ক্ষুব্ধ আরব দেশগুলো

তবে বাস্তবতা যেমনই হোক, সামরিক জোট গঠনে আরব দেশগুলোর যাত্রা এতটা মসৃণ হবে না। আরব দেশগুলোর মধ্যে এ নিয়ে বিভাজন রয়েছে।

সম্ভাব্য সামরিক জোটের নেতৃত্বে কে থাকবে ও কোথায় এর সদর দপ্তর হবে, তা নিয়ে ঐকমত্য না হওয়ায় ২০১৫ সালে মিসরের দেওয়া প্রস্তাব ভেস্তে গিয়েছিল। এ ছাড়া এ জোটে তুরস্কের মতো দেশকে রাখতে চায় না আরব দেশগুলো।

মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আরব নিউজে লেখা এক নিবন্ধে তুরস্কের রাজনৈতিক বিশ্লেষক সিনেম চেনগিজ বলেন, বিগত দুই দশকে তুরস্ক প্রতিটি জিসিসি সদস্যদেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও সামরিক সহযোগিতার মাধ্যমে যুক্ত হয়েছে। ২০০৪ সালে ইস্তাম্বুল কো-অপারেশন ইনিশিয়েটিভ (আইসিআই) চালু করার ক্ষেত্রেও আঙ্কারার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এতে সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার ও বাহরাইন অন্তর্ভুক্ত ছিল।

সিনেম আরও বলেন, পরবর্তী সময়ে এই অংশীদারত্বগুলোকে কূটনৈতিক আলোচনা থেকে শুরু করে প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের মতো বিভিন্ন কার্যকলাপ অন্তর্ভুক্ত করে হালনাগাদ করা হয়। কিন্তু এই উদ্যোগ আর বেশি দূর এগোয়নি।

মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে সম্পর্ক রাখায় ২০১৭ সালে কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে সর্বাত্মক অবরোধ আরোপ করে সৌদি আরব, মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইনসহ ছয়টি দেশ।

প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর শেষে আলিঙ্গন করছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ও সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ওই সময় অবরোধ তুলে নেওয়ার শর্ত হিসেবে দোহাভিত্তিক আল-জাজিরা চ্যানেল বন্ধ করা, ইরানের সঙ্গে সম্পর্কে সীমারেখা টানা, তুর্কি সামরিক ঘাঁটি বন্ধ করা ও অন্যান্য আরব দেশে নিষিদ্ধ সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্কচ্ছেদ করার শর্ত দেওয়া হয়। এতে জিসিসি দেশগুলোর মধ্যে ঐক্যে বড় ধরনের ফাটল ধরে।

ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম হারেৎজ বলেছে, সর্বশেষ কাতারে ইসরায়েলি হামলার পর দোহায় ছুটে যান আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদ। ওই সময় ইসরায়েলে আমিরাতের দূতাবাস বন্ধের অনুরোধ করেছিলেন কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি। তবে এতে সাড়া দেননি মোহাম্মদ বিন জায়েদ।

ইসরায়েলের আঞ্চলিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা, কাতারে দেশটির হামলা এবং সৌদি আরব ও পাকিস্তানের যৌথ প্রতিরক্ষার প্রেক্ষাপটে আরব ন্যাটো বা মুসলিম ন্যাটো ধারণা আবার আলোচনায় এসেছে।

তবে উপসাগরীয় দেশগুলোর ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থ এবং আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক আধিপত্যের হিসাব-নিকাশ থাকায় এ ধরনের কার্যকর সামরিক জোট গঠন এতটা সহজ হবে না বলেই মনে করা হচ্ছে।

প্রথম আলো থেকে নেয়া; সূত্র: মিডল ইস্ট আই, রয়টার্স, আরব নিউজ, ডন