“দ্য বোম্ব লেডি” নামটি শুনলে আপনি হয়তো হলিউডের থ্রিলার থেকে উঠে আসা কোন ভয়ংকর চরিত্রের কথা কল্পনা করবেন।
কিন্তু নগুয়েট আন ডুয়ং হলেন ৫ ফুট ১ ইঞ্চি উচ্চতার এক ভিয়েতনামী আমেরিকান বিজ্ঞানী। দেখতে বেশ সুন্দরী ও হাসিখুশি, চার সন্তানের জননী। অথচ এই শান্তশিষ্ট, প্রাণোচ্ছল রমনীই হলেন যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রাগারে থাকা সবচেয়ে ভয়ংকর অস্ত্রটি তৈরির মূল কারিগর।
তার জীবন কাহিনীতে মিশে আছে টিকে থাকার লড়াই, বিষ্ময়কর উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং যে দেশ তাকে উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় দিয়েছিল তার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতাবোধ।
১৯৭৫ সালের এপ্রিলে সায়গনের পতন হওয়ার মাত্র কয়েকদিন আগে তার পরিবার দেশ থেকে নৌকায় চড়ে পালিয়ে ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলার উত্তরে বাটান প্রদেশের একটি শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়। সেখানে বেদেদের মতো নৌকাতেই হয় তার পরিবারের আবাসস্থল। সেখান থেকে শরনার্থী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় পায় তার পরিবার।
নতুন জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ডুয়ং যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রাসায়নিক প্রকৌশল এবং কম্পিউটার বিজ্ঞানে দুটি ডিগ্রি অর্জন করেন, যা তার ক্যারিয়ারের ভিত্তি তৈরি, যা পরে আধুনিক যুদ্ধের রূপটিই বদলে দেয়।
১৯৮৩ সালে তিনি ইন্ডিয়ান হেড নেভাল সারফেস ওয়েপন্স সেন্টারে একজন রাসায়নিক প্রকৌশলী হিসেবে কাজ শুরু করেন।
থার্মোবারিক বোমার জন্ম
পরবর্তী দুই দশক ধরে ডুয়ং উন্নত বিস্ফোরক এবং সাগরতলে ব্যবহারযোগ্য অস্ত্র তৈরির কর্মসূচি পরিচালনা এবং নেতৃত্ব দেন। পরিশেষে তিনি এমন একটি দলের নেতৃত্ব দেন যারা তথাকথিত “থার্মোবারিক” বোমা তৈরি করে। এই অস্ত্র গুহা এবং বাঙ্কারের মতো সীমিত স্থানে ধ্বংসাত্মক ও টেকসই বিস্ফোরণ ঘটাতে সক্ষম।
থার্মোবারিক বোমা “জ্বালানি-বায়ু বিস্ফোরক” নামেও পরিচিত। এটি জ্বালানির মেঘ ছড়িয়ে দিয়ে কাজ করে, যা উচ্চ-তাপমাত্রার বিস্ফোরণ তরঙ্গ তৈরি করে, পরিবেশ থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং উচ্চমাত্রার চাপ তৈরি করে।
এটি ভূগর্ভস্থ টানেল বা বাঙ্কার অথবা এমন জায়গা যেখানে প্রচলিত বিস্ফোরক পৌঁছাতে পারে না তার বিরুদ্ধে বিশেষভাবে কার্যকর।
৬৭ দিনে অস্ত্র তৈরি
ডুয়ংয়ের নেতৃত্বে তার দল মাত্র ৬৭ দিনে মার্কিন বিমান বাহিনীর জন্য এই অস্ত্রটি তৈরি করেছিল, যা একটি অসাধারণ কীর্তি।
বোমার নকশাকালে তাত্ত্বিক বা খুব আশাবাদী ধারণার পরিবর্তে বাস্তব-দুনিয়ার অপারেশনাল চাহিদা – নিরাপত্তা, নির্ভরযোগ্যতা এবং কৌশলগত কার্যকারিতার উপর মনযোগ দেয়া হয়।
তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে শক্তিই পারে সংঘাত প্রতিরোধ করতে।
ডুয়ংয়ের কথা, “বোমা তৈরি করে আপনি অন্যদের বুঝতে দিন যে তাদের আমাদের সাথে ঝামেলা করা উচিত নয়। যদি আপনার কাছে বন্দুক থাকে, তবে আমার কাছে একটি কামান আছে।”
ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর (এমওপি)
ডুয়ং-এর থার্মোবারিক বোমা পরিবারের একটি হলো জিবিইউ-৫৭ ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর (এমওপি) । গত ২২ জুন (২০২৫) ইরানের ফর্দো ও নাতানজে পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংসের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এরকম ছয়টি বোমা নিক্ষেপ করে। এসব বোমার আরেক নাম “বাঙ্কার বাস্টার”।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, ডুয়ং নিজেই ইরানের ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংসের জন্য বোমার প্রযুক্তিগত লাইনেজ ঠিক করে দিয়েছিলেন।
এটি একজন নারীর জন্য গর্ব করার মতো বিষয়, যার কাজ আধুনিক সামরিক সক্ষমতাকে নতুন রূপ দিয়েছে।
আফগানিস্তানে আল-কায়দার সুড়ঙ্গ এবং গুহাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য ডুওং-এর নির্দেশনায় তৈরি করা লেজার-গাইডেড থার্মোবারিক বোমা বিএলইউ-১১৮/বি।
উদ্ভাবন
৯/১১-এর পর ডুওং আমেরিকার প্রথম থার্মোবারিক, বাঙ্কার-বাস্টিং বিস্ফোরক তৈরির জন্য একটি ক্র্যাশ প্রোগ্রামে প্রায় ১০০ জন বিজ্ঞানীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
বোমা তৈরি ছাড়াও তার কাজ ছিল অনেক বেশি বিস্তৃত: ২০০২ সাল থেকে তিনি নেভাল সারফেস ওয়ারফেয়ার সেন্টারে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার গবেষণা ভবিষ্যৎ অস্ত্র উন্নয়নের রূপটি নির্ধারণ করে।
২০০৯ সাল থেকে তিনি হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অধিদপ্তরে সীমান্ত এবং সামুদ্রিক নিরাপত্তা বিভাগের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
‘আমি যুদ্ধকে ঘৃণা করি’
এতকিছুর পরও নম্র স্বভাবের ডুয়ং শান্তির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, “আমি যুদ্ধ ঘৃণা করি। আমি প্রতিরোধক হিসেবে অস্ত্র তৈরি করি।”
তার জীবনের লক্ষ্য একান্ত ব্যক্তিগত: “আমি এখানে আছি কারণ ভিয়েতনামে আমাদের গুলি ফুরিয়ে গিয়েছিল। আমি আর কখনও সেই অবস্থায় ফিরে যেতে চাই না।”
বোমা জননীর উত্তরাধিকার
যুদ্ধ থেকে পালিয়ে আসা একজন শরণার্থী থেকে আমেরিকার প্রতিরক্ষা কাঠামো বদলে দেয়া শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানীতে পরিণত হওয়া নগুয়েট আন ডুয়ং প্রাণোচ্ছলতা, মেধা ও নিষ্ঠার প্রতীক।
তার থার্মোবারিক বোমা সামরিক কৌশলকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করেছে, যা সেনাদলকে সুরক্ষা দেয় এবং প্রতিপক্ষকে একইভাবে প্রতিরোধ করে।
ডুয়ং নিজেই বলেছেন, “একবার বোমা তৈরি হয়ে গেলে সেগুলো কীভাবে ব্যবহার করা হবে সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা আমার থাকে না। আমাদের নেতৃত্বের উপর আপনাকে ভরসা করতে হবে।”
গাল্ফ নিউজ থেকে অনুবাদ