ইরানের পক্ষে ইসরায়েলে পারমাণবিক হামলা চালাবে পাকিস্তান?

ইরানের পক্ষে ইসরায়েলে পারমাণবিক হামলা চালাবে পাকিস্তান?
পাকিস্তানের শাহিন-৩ ব্যলিস্টিক ক্ষেপনাস্ত্র এবং (ইনসেটে) ইরানের জেনারেল মোহসেন রেজাই। ছবি: সংগৃহীত

ইরানে পারমাণবিক হামলা চালালে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পাকিস্তান পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে। ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সিনিয়র সদস্য মোহসেন রেজাইয়ের এই দাবি নিয়ে জোর বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিশ্বের প্রভাবশালী ও নির্ভরযোগ্য মিডিয়াগুলো এ ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকলেও ভারতীয় মিডিয়ায় এ নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা চলছে। এটা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতীয় প্রপাগাণ্ডা, নাকি ইরানের হাতেই গোপন পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে – সেই সন্দেহও দানা বাঁধছে।

ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেয়া এক বক্তব্যে ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি)-এর জেনারেল মোহসেন রেজাই বলেন, পাকিস্তান আমাদের জানিয়েছে যে যদি ইসরায়েল পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে, তাহলে তারাও পারমাণবিক অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করবে।

ইসরায়েলি হামলার পর পাকিস্তান ইরানের প্রতি দৃঢ় সমর্থন ঘোষণা করে। এরপর ইরানি টেলিভিশনে রেজাইয়ের ওই বক্তব্য প্রচারিত হয়। বৃহত্তর মুসলিম ঐক্যের প্রেক্ষাপটে ইসলামাবাদ ইরানের প্রতি সংহতি প্রকাশ করলেও পাকিস্তানের কোনও সামরিক বা বেসামরিক নেতা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করেননি।

রেজা আরো জোর দিয়ে বলেন যে ইরান এখনো তার সব ক্ষমতা এবং কৌশল জনগণ বা প্রতিপক্ষের কাছে প্রকাশ করেনি।

তার এই বক্তব্যকে অনেকে ভিন্ন কিছুর ইংগিত বলেও মনে করছেন।

১৪ জুন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে দেয়া বক্তব্যে প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য আহ্বান জানান।

তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন যে ইসরায়েল ইরান, ইয়েমেন এবং ফিলিস্তিনকে লক্ষ্যবস্তু করেছে। যদি মুসলিম বিশ্ব এখনই ঐক্যবদ্ধ না হয়, তাহলে প্রত্যেকের একই পরিণতি ভোগ করতে হবে।

তেল আবিবের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখা মুসলিম দেশগুলোর প্রতি সম্পর্ক ছিন্ন করারও আহ্বান জানান তিনি।

আসিফ ইসরায়েলি আঞ্চলিক অভিযানের বিরুদ্ধে একটি সম্মিলিত কৌশলগত এবং কূটনৈতিক অবস্থান গ্রহণের জন্য ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি)’র জরুরি শীর্ষ সম্মেলন দাবি করেন।

তিনি বলেন, ইরানের সাথে পাকিস্তানের গভীর সম্পর্ক রয়েছে এবং এই কঠিন সময়ে ইসলামাবাদ তেহরানের পাশে দাঁড়িয়েছে। আমরা ইরানের সঙ্গে আছি এবং প্রতিটি আন্তর্জাতিক ফোরামে তাদের সমর্থন করব।

পাকিস্তানি প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যকে অনেক রাজনৈতিক বলে মনে করেন। কেউ কেউ এমন কৌশলগত প্রশ্নও তোলেন যে দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে পারমাণবিক শক্তি প্রদর্শনের ক্ষমতা বা ইচ্ছা – কোনটিই কি পাকিস্তানের আছে?

পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থা এবং পারমাণবিক শক্তি পর্যবেক্ষণকারী সংস্থাগুলোর মতে, ২০২৫ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত পাকিস্তানের কাছে প্রায় ১৭০টি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে, যা বছরের শেষ নাগাদ প্রায় ২০০তে পৌঁছাতে পারে।

অনুমান করা হয় যে অদূর ভবিষ্যতের এই সংখ্যা ২২০ থেকে ২৫০টিতে দাঁড়াবে। তখন ওয়ারহেড সংখ্যায় পাকিস্তান ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে এবং বিশ্বের পঞ্চম বা ষষ্ঠ বৃহত্তম পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্রে পরিণত হবে।

এটা ঠিক, ভারত এবং চীনের বিপরীতে, পাকিস্তান স্পষ্টতই ‘প্রথম ব্যবহার নয়’ নীতি গ্রহণ করেনি। দেশটির পারমাণবিক নীতি নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। তারা উত্তেজনার কোন সীমা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে সেটা ভাবনার বিষয়।

এই নীতির কারণে পাকিস্তান তার পারমাণবিক অস্ত্রাগার বৈচিত্র্যময় করেছে। যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য এতে রয়েছে নসর (হাতফ-৯)-এর মতো স্বল্প-পাল্লার ব্যবস্থা, মাঝারি থেকে দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সিরিজ শাহীন ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র সিরিজ বাবর।

এগুলোর মধ্যে ভূ-রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল মাঝারি-পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র শাহীন-৩, যার ঘোষিত পাল্লা ২,৭৫০ কিলোমিটার। পশ্চিম বা দক্ষিণ পাকিস্তান থেকে শাহিন-৩ উৎক্ষেপণ করা হলে গোটা ভারতই শুধু নয় বরং ইসরায়েলসহ গোটা মধ্যপ্রাচ্য এই ক্ষেপনাস্ত্রের আওতায় আসবে।

ইসরায়েলকে পারমাণবিক লক্ষ্যবস্তু তালিকার মধ্যে রাখার কোনও ঘোষণা কখনো দেয়নি ইসলামাবাদ কিন্তু চরম আঞ্চলিক পরিস্থিতি বা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে প্রযুক্তিগত সক্ষমতার কারণে তেল আবিব তার নাগালের মধ্যে থাকবে এটা কল্পনা করা যায়।

আরব ও মুসরিম দেশগুলোর সাথে পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের সম্প্রীতি, ফিলিস্তিনি স্বার্থের প্রতি তার সুদৃঢ় সমর্থনের কারণে বিশ্লেষকরা ইসরায়েল-ইরান সংঘাতে পাকিস্তানের ভূমিকা পুনর্মূল্যায়ন করতে শুরু করেছেন।

কঠিন জ্বালানি চালিত, সড়ক পথে স্থানান্তরের সুবিধা এবং আধুনিক ইনার্শিয়াল গাইডেন্স সিস্টেমের কারণে শাহীন-৩ দ্রুত মোতায়েন করা যায় এবং এর টিকে থাকার সক্ষমতাও বেশি। এতে পাকিস্তানের দ্বিতীয়-আঘাত হানার সামর্থ্য দাবির বিশ্বাসযোগ্যতা বেড়েছে।

আঞ্চলিক রণকুশলীদের জন্য আরও উদ্বেগের বিষয় হল, পাকিস্তানের ‘মাল্টিপল ইন্ডিপেনডেন্টলি টার্গেটেবল রি-এন্ট্রি ভেহিকেল’ ক্ষমতাসম্পন্ন আবাবিল নামক ক্ষেপনাস্ত্র।

এর উন্নয়নে সফল হলে মাত্র একটি ক্ষেপনাস্ত্র দিয়ে একাধিক ওয়ারহেড নিক্ষেপের ক্ষমতা লাভ করবে পাকিস্তান। এর একটি ক্ষেপনাস্ত্র দিয়ে একাধিক লক্ষ্যবস্তুকে টার্গেট করা যাবে। তখন ভারতের এস-৪০০ এবং ইসরায়েলের অ্যারো বা আয়রন ডোমের মতো উন্নত বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে আবাবিল ঠেকানো সম্ভব হবে না।

পাকিস্তানের দ্রুত অগ্রসরমান পারমাণবিক ক্ষমতা কেবল দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে নয়, বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যের কৌশলগত ব্যবস্থায়ও নতুন জটিলতার সূচনা করেছে। বিশেষ করে ইসরায়েল-ইরান সম্পর্কে অবনতির কারণে এই জটিলতা বেড়েছে।

আদর্শিক জোট, ধর্মীয় সংহতি বা ভূ-রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাস দ্বারা পরিচালিত হয়ে ইসলামাবাদ যদি ভবিষ্যত সংঘাতের পরিস্থিতিতে তার মুখ পশ্চিম থেকে ফিরিয়ে নিতে চায় তাহলে ইসরায়েলে আঘাত হানার প্রযুক্তিগত ক্ষমতা ওই অঞ্চলকে নি:সন্দেহে প্রভাবিত করবে।