ইরানি প্রেসিডেন্টের সফর বিশ্ব রাজনীতিতে পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের ইঙ্গিত

ইরানি প্রেসিডেন্টের সফর বিশ্ব রাজনীতিতে পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের ইঙ্গিত
ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ (ডানে)। ছবি: সংগৃহীত

ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান এমন এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে (২-৩ আগস্ট) পাকিস্তান সফর করেছেন যখন দ্রুত পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনৈতিক দৃশ্যপটে ইসলামাবাদের সাথে সম্পর্ক জোরদার করতে তেহরানের সতর্ক প্রচেষ্টার প্রতিফলন ঘটেছে।

এই সফরে পাকিস্তান ও ইরান দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বার্ষিক ১০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে বেশ কয়েকটি চুক্তি সই করে। দুই দেশ তাদের সীমান্ত অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আরও কার্যকরভাবে লড়াই করতেও রাজি হয়েছে।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফের সাথে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে পেজেশকিয়ান বলেন, আমরা খুব সহজেই, অল্প সময়ের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ বর্তমান ৩ বিলিয়ন ডলার থেকে ১০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে পারি। পাকিস্তানি নেতাও আশা প্রকাশ করে বলেন যে ১০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য লক্ষ্যমাত্রা খুবই দ্রুত অর্জন করা সম্ভব হবে।

সফরকালে ইরানের প্রেসিডেন্ট পাকিস্তানে শীর্ষ সামরিক নেতৃত্বের সাথে বৈঠক করেন, যাদের মধ্যে ছিলেন জয়েন্ট চিফস অফ স্টাফ কমিটির চেয়ারম্যান জেনারেল সাহির শামশাদ মির্জা, বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল জহির বাবর সিধু এবং ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আসিম মালিক।

অনেক কারণে এই সফর ছিল গুরুত্বপূর্ণ এবং ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে এটি দ্বিপাক্ষিকতার সীমা ছাড়িয়ে গেছে।

গত জুনে ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের পর পেজেশকিয়ানের প্রথম বিদেশ সফর ছিল পাকিস্তানে। ইরানের উপর ইসরায়েলি হামলা এবং পরে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন বিমান হামলার কারণে ইরান আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা মোকাবেলায় আঞ্চলিক অংশীদার খুঁজে নিতে বাধ্য হয়েছে।

ইসরায়েলি-মার্কিন হামলাকে ইরানের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন বলে নিন্দা জানায় পাকিস্তান। তাছাড়া, তেহরানের আত্মরক্ষার অধিকার সমর্থন করে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরানের প্রতিশোধমূলক আক্রমণকে ন্যায্যতা দিয়েছে ইসলামাবাদ। তারা জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক ফোরামেও ইরানকে সমর্থন করেছে।

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত আঞ্চলিক অস্থিতিশীল সৃষ্টি করতে পারে বলে পাকিস্তানে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। এই যুদ্ধের প্রভাব অস্থিতিশীল বেলুচিস্তান প্রদেশে পড়তে পারে বলে সে আশঙ্কা করে। পশ্চিম সীমান্তের কাছে ইসরায়েলি বিমানের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কারণে নিরাপত্তার গতিশীলতা পরিবর্তন নিয়েও ইসলামাবাদে উদ্বেগ দেখা দেয়। পারমাণবিক শক্তি ও ভারতের সাথে তার প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে পাকিস্তানের জন্য এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

ইরানের সাথে তার ৯০৫ কিলোমিটার সীমান্তে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে চায় পাকিস্তান। সে চায় না যে ইরানের শাসনব্যবস্থা এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ুক যাতে দুই দেশের সীমান্ত অঞ্চল চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়। এরই প্রেক্ষাপটে, পেজেশকিয়ানের পাকিস্তান সফর ভবিষ্যৎ আগ্রাসন রোধে ইসলামাবাদের সাথে সম্পর্ক শক্তিশালী করতে তেহরানের প্রচেষ্টার ইঙ্গিত দেয়।

এই সফর আরো মনে করিয়ে দেয় যে, ইরানকে নিয়ে পাকিস্তানের বর্তমান কূটনৈতিক কৌশল তেহরানের সাথে তার গতানুগতিক সম্পর্ককে ছাড়িয়ে গেছে।

পাকিস্তান নিজেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে সম্ভাব্য মধ্যস্থতাকারী হিসাবে উপস্থাপন করতে চাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। ইরানি প্রেসিডেন্টের সফরকালে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনায় ইরান-মার্কিন উত্তেজনা কমাতে পাকিস্তানের ভূমিকা নিয়ে কথা হতে পারে। অতীতে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার উত্তেজনা কমাতে ইসলামাবাদ ভূমিকা রাখতে পারে বলে ইংগিত দিয়েছেন। সাম্প্রতিককালে ওয়াশিংটন একাধিকবার এই ভূমিকার কথা স্বীকার করেছে।

এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, আমেরিকার সাথে উষ্ণ সম্পর্ক পাকিস্তানের আঞ্চলিক গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। এক্ষেত্রে, ইরান-মার্কিন সংঘাতে ইসলামাবাদের সম্ভাব্য তৃতীয় পক্ষের ভূমিকা ওয়াশিংটনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।

অত্যন্ত জটিল আঞ্চলিক গতিশীলতার মধ্যে ইরানের প্রেসিডেন্টর সফরটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। একদিকে, পাকিস্তান-মার্কিন সম্পর্ক উষ্ণ হচ্ছে – সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় পাকিস্তানকে প্রকাশ্যে “অসাধারণ অংশীদার” বলে অভিহিত করেছে ওয়াশিংটন। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত মে মাসে তার মধ্যস্থতা মেনে নিয়ে ভারতের সাথে সামরিক সংঘাত বন্ধ করতে রাজি হওয়ার জন্য পাকিস্তানি নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন।

পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে উত্তেজনার কারণে সাম্প্রতিককালে ইরান-মার্কিন সম্পর্ক আরো তিক্ত হয়েছে। অন্যদিকে, বিশেষ করে রাশিয়ার সাথে তেল বাণিজ্য কমাতে নয়াদিল্লির উপর শাস্তিমূলক শুল্ক আরোপ করার পর আমেরিকার সাথে ভারতের সম্পর্ক খারাপ হয়েছে।

২০২৫ সালের এপ্রিলে পহেলগাম হামলাকে কেন্দ্র করে সামরিক সংঘাতের পর থেকে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।

এই অবস্থায়, পাকিস্তান ও ইরান উভয়েরই গুরুত্বপূর্ণ মিত্র চীন তার ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (বিআরআই) এগিয়ে নিতে বর্তমান পরিস্থিতিকে কাজে লাগাবে বলে মনে হচ্ছে।

এই দ্রুত পরিবর্তনশীল আঞ্চলিক গতিশীলতা এবং জোট ও স্বার্থের জাল পাকিস্তানকে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ের জায়গায় বসিয়ে দিয়েছে। ওয়াশিংটনের সাথে তার উদীয়মান সম্পর্ক, ইরানের প্রতি খোলামেলা সমর্থন এবং অস্থির আঞ্চলিক দৃশ্যপটের মধ্যে চীনের সাথে দৃঢ় সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে ইসলামাবাদ সফলভাবে নিজেকে একটি আঞ্চলিক স্থিতিশীলকারী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে বলে মনে হচ্ছে।

আগামীতে বৈশ্বিক শক্তি এবং আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতার মধ্যে ইসলামাবাদের কূটনৈতিক দক্ষতার পরীক্ষা হবে।

তবে, ইরানি প্রেসিডেন্টের এই সফর এমন এক শক্তিশালী অংশীদারিত্বের ইঙ্গিত দিচ্ছে যা দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যতকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করবে, যেখানে পাকিস্তানের ভূমিকা হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

দ্য ডিপ্লোম্যাট থেকে অনুবাদ