২০২৪ সালের শুরুর দিকে ঢাকায় একটি এক্সক্লুসিভ আলোচনা সভায় আমি উপস্থিত ছিলাম। বিষয় ছিল—বার্মা অ্যাক্ট, মিয়ানমারের পরিস্থিতি, পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন গ্রুপের তৎপরতা এবং বাংলাদেশে এর সম্ভাব্য প্রভাব। সভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল মেজর জেনারেল (অব.) মনিরুজ্জামানের বিপস কার্যালয়ে। উপস্থিত ছিলেন বর্তমান পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনসহ আরও কয়েকজন নীতি–নির্ধারক।
আলোচনায় জাতিসংঘের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মিয়ানমার ও সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে যে সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন, তা ছিল চোখ–খোলার মতো। ঢাকা ছাড়ার আগে এক অনানুষ্ঠানিক ককটেল পার্টিতে তিনি আরও খোলামেলা কথাও বলেছিলেন। তবে এসব আলোচনা কখনো প্রকাশিত হয়নি।
রাজনৈতিক নয়, কৌশলগত সংকট
আমাদের সাধারণ রাজনৈতিক আলোচনায় অনেকেই এই জটিল বাস্তবতাকে কেবল দলীয় দ্বন্দ্ব বা ক্ষমতার পালাবদলের প্রেক্ষাপটে ব্যাখ্যা করেন। কিন্তু সত্য হলো—এটি নিছক রাজনৈতিক সংকট নয়; বরং গভীর কৌশলগত সংকট। রাজনীতিবিদরা যদি এ বাস্তবতা বুঝতে না পারেন, তাহলে বিপর্যয় এড়ানোর কোনো সুযোগ থাকবে না।
২০২২ সাল থেকে ঢাকায় বিভিন্ন কূটনৈতিক মহলে আমার অংশগ্রহণে হওয়া আলোচনাগুলো থেকে নিশ্চিত হয়েছি যে দক্ষিণ এশিয়া এখন এক অনিবার্য ঝুঁকির দিকে এগোচ্ছে। এর কেন্দ্রবিন্দু বা এপিসেন্টার হচ্ছে বঙ্গোপসাগর, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম ও মিয়ানমার সীমান্ত অঞ্চল।
সীমান্ত ও আঞ্চলিক অস্থিরতা
যদি মিয়ানমার, ভারতের মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা অঞ্চলের দিকে তাকাই, স্পষ্ট হয়ে যায়—সেখানে এক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বিদ্রোহী গোষ্ঠী, অবৈধ অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা, আন্তঃসীমান্ত সশস্ত্র চাঁদাবাজি—সবকিছু মিলিয়ে এই অঞ্চল অস্থিরতার আগ্নেয়গিরি হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এই অঞ্চল সরাসরি আমাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও অর্থনীতিকে প্রভাবিত করছে। কিন্তু আমাদের কৌশলগত প্রস্তুতি নগণ্য।
রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়ির বাইরে দেখতে হবে
আজও আমরা চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, ওয়েস্টিন কেলেঙ্কারি, হাঁস–পাথর ইস্যু বা দলীয় কাদা ছোড়াছুড়িকে কেন্দ্র করে বিতর্কে মেতে আছি। বিএনপি–আওয়ামী লীগ কিংবা জামায়াত–এনসিপি বিরোধ হয়তো রাজনৈতিক তর্কে প্রাসঙ্গিক, কিন্তু কৌশলগত বাস্তবতায় এগুলো এখন অপ্রাসঙ্গিক প্রায়।
অদক্ষ উপদেষ্টা ও সেকেলে চিন্তাধারা আমাদের ভুল পথে ঠেলে দিচ্ছে। অনেক আঁতেল এখনো সত্তর–আশির দশকের থিওরি দিয়ে নতুন প্রজন্মকে বোঝাতে চান। অথচ বিশ্বের ভূরাজনীতি, প্রযুক্তি, সামরিক কৌশল এবং অর্থনৈতিক বাস্তবতা আমূল বদলে গেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তর প্রেক্ষাপট
দক্ষিণ এশিয়া আজ বড় ধরনের ভৌগোলিক–রাজনৈতিক রূপান্তরের সামনে দাঁড়িয়ে। চীন–ভারত প্রতিদ্বন্দ্বিতা, যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্দো–প্যাসিফিক কৌশল’, মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ, বঙ্গোপসাগরে সামরিক শক্তির উপস্থিতি—সবকিছু মিলে এই অঞ্চলকে ঝুঁকির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে।
বাংলাদেশের জন্য এর মানে হচ্ছে: আমাদের কৌশলগত অবস্থান নির্ধারণে ভুলের কোনো সুযোগ নেই। একদিকে সীমান্ত সুরক্ষা, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক জোট–রাজনীতির ভারসাম্য—এই দুইয়ের মধ্যে সূক্ষ্ম সমন্বয় ছাড়া নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
বার্মা অ্যাক্ট: সুযোগ নাকি বিপদ?
এই প্রেক্ষাপটে ‘বার্মা অ্যাক্ট’ বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। প্রশ্ন হচ্ছে—বাংলাদেশ কি এ থেকে নিজের কৌশলগত সুযোগ তৈরি করতে পারবে, নাকি উল্টো বিপদে জড়িয়ে পড়বে? বাস্তবতা হলো: হয় বাংলাদেশ বার্মা অ্যাক্টকে কৌশলগতভাবে কাজে লাগাবে, নয়তো ছারখার হয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
উপসংহার
এখন সময় আবেগ, হুজুগ ও হাইপের বাইরে এসে বাস্তবতাকে বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। আমরা ইতোমধ্যেই দেরি করে ফেলেছি, ভুল পথে হাঁটছি। সামনের দিনগুলোতে যদি সঠিক কৌশলগত পদক্ষেপ না নেই, তবে গভীর গহ্বরে পতন অনিবার্য হবে।
বাংলাদেশের সামনে এখন দুটি পথ: ১. বার্মা অ্যাক্ট থেকে সুযোগ নেওয়া; অথবা ২. অনিবার্য ছারখারের জন্য প্রস্তুত থাকা। অন্য কোনো বিকল্প নেই।