যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি ইমিগ্রান্টের সংখ্যা খুব বেশি নয়। “আমেরিকান কমিউনিটি সার্ভে’র জরিপ অনুযায়ী ২০২০ সালে বৈধ-অবৈধ মিলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি সংখ্যা দুই লাখের কম ছিল। গত সাড়ে চার বছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে মোট সংখ্যা দুই লক্ষাধিক হতে পারে। তারা পরিশ্রমী এবং কয়েকটি ক্ষেত্রে তাদের অবদান প্রশংসিত। বাংলাদেশিদের প্রায় অর্ধেকই বাস করেন নিউইয়র্ক সিটিতে। এখানে বাংলাদেশি ছাড়া ক্যাব সার্ভিস অচল হয়ে পড়বে। কারণ, সিটির ৬০ শতাংশের বেশি ক্যাবি বাংলাদেশি। সাবওয়ে স্টেশন এবং সাইডওয়াকের ক্যান্ডি স্টোরগুলোর মালিক অধিকাংশই বাংলাদেশি। কিছু ফাস্টফুড চেইনের ফ্রাঞ্চাইজে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশিরা। সিটির পুলিশে বিভাগেও অনেক বাংলাদেশি।
বাংলাদেশিদের দ্বিতীয় এর পরের পছন্দনীয় স্থান ক্যালিফোর্নিয়া, এবং বিশেষ করে লস অ্যাঞ্জেলেস সিটি, যেখানে আনুমানিক ১৪ হাজার বাংলাদেশি আছেন। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে নিউইয়র্কের প্রতিবেশি স্টেট নিউ জার্সি, যেখানে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার বাংলাদেশির বসবাস। নিউইয়র্ক ও ক্যালিফোর্নিয়া দুটিই জনবহুল স্টেট এবং ঐতিহ্যগতভাবে ডেমোক্রেট স্টেট। ট্রাম্প প্রশাসন দুই স্টেট থেকে অবৈধ ইমিগ্রান্টদের গ্রেফতার ও ডিপোর্টেশন কার্যক্রম জোরদার করেছেন।
গত ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ ৪৩ জন অবৈধ বাংলাদেশিকে ডিপোর্ট করেছে। এ সংখ্যা অন্যান্য দেশের ডিপোর্টেড সংখ্যার চেয়ে অনেক কম। কর্তৃপক্ষ আরো চার থেকে পাঁচশ’ বাংলাদেশির অভিবাসীর রেকর্ড যাচাই করছে বলে জানা গেছে। এসব বাংলাদেশির অনেকে দীর্ঘদিন থেকে সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করলেও তারা গ্রিনকার্ডধারী নন। তাদের অধিকাংশের অ্যাসাইলাম আবেদন বিভিন্ন পর্যায়ে বিবেচনাধীন। বাংলাদেশি ইমিগ্রান্টদের বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধ ঘটানোর রেকর্ডও খুব বেশি নেই। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে ট্রাফিক আইন লংঘন বা ডমেস্টিক ভায়োলেন্সের অভিযোগ থাকলেও সেগুলো ‘গুরুতর অপরাধ’ হিসেবে গন্য নয়।
তবে এর ব্যতিক্রমও আছে। গত প্রায় দেড় দশকে নিউইয়র্কে তিনটি ঘটনায় তিন জন বাংলাদেশি অভিবাসী সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে একজনকে ৩০ বছর, একজনকে ৫৫ বছর এবং আরেকজনকে ৪২ মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে। প্রথম ঘটনায় বাইশ বছর বয়সী বাংলাদেশি যুবক কাজী মুহাম্মদ রেজওয়ানুল আহসান নাফিস এফবিআই (ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন) এর ‘স্টিং অপারেশন’ বা পাতা ফাঁদে পড়ে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল ২০১২ সালের অক্টোবরে। নাফিস আদালতে তার অপরাধ স্বীকার করেছিলেন। একবছর পর ২০১৩ সালের নভেম্বরে আদালত তাকে ৩০ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করে।
প্রকৃত ঘটনা ছিল, নাফিস একটি গাড়িতে প্রায় এক হাজার পাউন্ড ওজন বিশিষ্ট যে বোমাটি ম্যাহাটানে অবস্থিত নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের গেটের সামনে বিস্ফোরণ ঘটানো চেষ্টা করেন সেটি সত্যিকারের কোনো বোমা ছিল না। এফবিআই তাদের সন্দেহভাজনদের যাচাই করতে এ ধরনের নকল বিস্ফোরক বা নকল অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে তাদের মনে বিশ্বাস জন্মায় যে এগুলো প্রকৃত বিস্ফোরক বা প্রকৃত অস্ত্র। নাফিস অনুরূপ জালে ফেঁসে গিয়ে বর্তমানে দণ্ড ভোগ করছেন। নাফিস যুক্তরাষ্ট্রে বৈধভাবে এসেছিলেন পড়াশোনা করতে।
দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে। নিউইয়র্ক সিটির ম্যানহাটানে ব্যস্ততম পরিবহন কেন্দ্র পোর্ট অথরিটি বাস টার্মিনালে বোমা হামলার চেষ্টা চালানোর দায়ে বাংলাদেশি অভিবাসী যুবক আকায়েদ উল্লাহকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় ফেডারেল আদালত। পাশাপাশি তাকে আরো ৩০ বছরের সাজার রায় শোনান বিচারক। যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কোনো অঙ্গরাজ্যে যাবজ্জীন কারাদণ্ডকে ২৫ বছর হিসাব করা হয়। ফলে আকায়েদ উল্লাহ’র দণ্ড দাঁড়ায় মোট ৫৫ বছর। ধারণা করা যায় যে, ৩১ বছর বয়স্ক আকায়েদ উল্লাহকে অবশিষ্ট জীবন কারাগারেই কাটাতে হবে। উল্লেখ্য, তিনি টাইমস স্কোয়ার সাবওয়ে স্টেশন থেকে পোর্ট অথরিটি বাস টার্মিনালে যাওয়ার ভূগর্ভস্থ পথে নিজের বুকে বাঁধা ‘পাইপ বোমার’ বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলেন। বোমাটি ঠিকমতো বিস্ফোরিত না হওয়ায় ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপক না হলেও তিন পুলিশ সদস্য আহত হন। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তিনি মধ্যপ্রাচ্যে আইএস (ইসলামিক স্টেট) এর তৎপরতা ও প্রচারণায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন বলে স্বীকার করেছিলেন।
তৃতীয় ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির নেতা মোহাম্মদউল্লাহ মামুনের পুত্র রিজভি আহমেদ সিজারকে (৩৬) সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ প্রচেষ্টা ও জয়ের বিরুদ্ধে ৩০০ মিলিয়ন ডলার দুর্নীতির ফাইল সংগ্রহের জন্য এফবিআই এর দুজন সাবেক এজেন্টকে ঘুস প্রদানের অভিযোগ। নিউইয়র্ক পুলিশ ২০১৩ সালে তাকে গ্রেফতার করে। তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৫ সালে আদালত তাকে ৪২ মাসের কারাদণ্ড এবং ঘুস গ্রহণকারী এফবিআই এর সাবেক এজেন্ট রবার্ট লাসটিককে ৫ বছর এবং অপর সাবেক এফবিআই এজেন্ট জোহানেস থালেরকে ৩০ মাসের কারাদণ্ড প্রদান করে।
এছাড়া ২০১৬ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান হোজে সিটিতে বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত আমেরিকান তরুন হাসিব (২৪) হাসিব বিন গোলাম রাব্বি গুলি করে তার শিক্ষাবিদ বাবা-মাকে গুলি করে হত্যা করায় আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে। জানা যায়, হাসিব গে ছিল এবং তার শ্বেতাঙ্গ সেক্স পার্টনারকে বিয়ে করতে বা বাড়িতে একসাথে রাখতে চেয়েছিল কোন বাংলাদেশি পরিবার এটা মানবে? অতএব, যা ঘটার তাই ঘটেছে। হাসিব একা নয়। চুপচাপ অনাচার সয়ে যাচ্ছে অনেক বাংলাদেশি পরিবার।
বাংলাদেশিরা তো ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারত জয়ের মতো আমেরিকা জয় করতে আসেনি। এসেছে কাজকর্ম করতে, পড়াশোনা করতে। অতএব, দীর্ঘ অবস্থানে বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত আমেরিকানদের একটি অংশ গে হবে, লেসবিয়ান হবে এটাই স্বাভাবিক। আমেরিকা ভালো, তাদের সেক্স অরিয়েন্টেশনও নতুন প্রজন্মের একটি অংশের কাছে ভালো। হাসিবের ক্ষেত্রে পিতামাতার রিলিজিয়াস অরিয়েন্টেশন কাজে লাগেনি, অতি-প্রাচীনকালে যেমন কাজে লাগেনি সমকামিতার বিরুদ্ধে লুত আ: এর ওয়াজ-নসিহত। তখন আল্লাহর গজব আসতো, এখন আসে না। লাউড এন্ড ক্লিয়ার!
অবৈধ ইমিগ্রান্ট ধরপাকড় শুরু হওয়ার পর প্রবাসী বাংলাদেশিদের মনে বহু বছর আগের ঘটনাগুলো নতুন করে স্মরণ করছে। যদিও একটি ঘটনার সঙ্গে আরেকটি ঘটনার সম্পর্ক নেই। কিন্তু অপরাধ তো অপরাধই এবং কোনো কমিউনিটির সদস্যরা এ ধরনের অপরাধ করলে তা পুরোসমগ্র কমিউনিটিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলে। অন্যান্য কমিউনিটির লোকজন ভীতি ও সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে। প্রশাসন ডিপোর্টেশনের ক্ষেত্রে এসব ঘটনা সামনে নিয়ে আসে।
ফেসবুক লিংক: https://www.facebook.com/share/p/1Dwd8PZZSt/