অভ্যন্তরীণ অস্থিরতায় বাধাগ্রস্ত বাংলাদেশের আসিয়ানে যোগদানের ইচ্ছা

অভ্যন্তরীণ অস্থিরতায় বাধাগ্রস্ত বাংলাদেশের আসিয়ানে যোগদানের ইচ্ছা
২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থান, যার পরিণতিতে ক্ষমতা ছেড়ে দেশ থেকে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি সংগৃহীত

আসিয়ান সদস্যপদ লাভের জন্য নতুন করে প্রচেষ্টা শুরু করেছে বাংলাদেশ। এ জন্য মালয়েশিয়ার সমর্থন কামনা করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন নেতা মুহাম্মদ ইউনূস। কিন্তু এই মুহূর্তে তীব্র অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা এবং শাসন ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন দেশটির ইচ্ছার বিরুদ্ধে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দশ সদস্যের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয় দেশগুলোর সংস্থার (আসিয়ান) সদস্যপদ লাভের জন্য গেল সপ্তাহে (২৭ জুলাই) ড. ইউনূস কুয়ালালামপুরের সমর্থন কামনা করেন। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের মেয়ে এবং পিপলস জাস্টিস পার্টির সহ-সভাপতি নুরুল ইজ্জাহ ঢাকায় তার অফিসে সাক্ষাত করতে গেলে ড. ইউনূস তাকে বলেন, আমরা আসিয়ানের অংশ হতে চাই এবং আমাদের আপনার সমর্থন প্রয়োজন।

আসিয়ানের বর্তমান সভাপতি হিসেবে মালয়েশিয়া বাংলাদেশের ‘সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার’ হওয়ার আবেদন অনুমোদনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এটা পূর্ণ সদস্যপদ লাভের পথে একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ।

ঢাকা ২০২০ সালে প্রথম এই মর্যাদা লাভের জন্য আবেদন করে। এই মর্যাদা পেলে দেশটি আসিয়ানের সঙ্গে অন্তত দুটি ক্ষেত্রে জড়িত হতে পারবে – বাণিজ্য ও অর্থনীতি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি।

তবে, এর পরের পথটি বেশ কঠিন। দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদ ডরিস লিউয়ের মতে, আসিয়ানে যোগদানের জন্য বাংলাদেশ “গুরুত্বপূর্ণ” চ্যালেঞ্জের সম্মুখিন।

তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, পূর্ণ সদস্যপদতো বটেই, এমনকি পর্যবেক্ষক মর্যাদা পেতে হলেও টেকসই রাজনৈতিক সদিচ্ছা, ব্যাপক আলোচনা এবং প্রশাসনিক বাধা অতিক্রম করতে হবে। বর্তমানে ড. ইউনূসই এই প্রক্রিয়া এগিয়ে নিচ্ছেন।

তবে অন্তবর্তী সরকারের পরেও এই উদ্যোগ টিকে থাকবে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান লিউ।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রচেষ্টাকে “গুরুত্ব সহকারে নেওয়ার” জন্য ঢাকাকে একটি স্থিতিশীল সরকার নিশ্চিত করতে হবে। সেই সাথে সুসংগত নীতি অনুসরণ এবং অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা অর্জন করতে হবে।

মিয়ানমারে দীর্ঘমেয়াদী অস্থিরতার কারণে নতুন সদস্যপদ বিবেচনার ক্ষেত্রে আসিয়ান সতর্কতার সাথে অগ্রসর হবে বলে তিনি মনে করেন।

পূর্ব তিমুরের সদস্যপদের ক্ষেত্রেও দীর্ঘ বিলম্ব ঘটছে। সদস্যপদ লাভের জন্য দিলি ২০১১ সালে আবেদন করে মাত্র ২০২২ সালে পর্যবেক্ষক মর্যাদা পায় এবং এখনও পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ পায়নি। বাংলাদেশও একই রকম দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হতে পারে বলে লিউ মনে করেন।

গত বছরের আগস্টে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অনির্বাচিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে শাসিত হচ্ছে। দেশের প্রধান বিরোধী দল সতর্ক করে দিয়েছে যে, চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন না হলে দেশ অস্থিতিশীল এবং জনসাধারণের “ক্ষোভ” তীব্র হতে পারে।

আসিয়ানের সদস্যপদ প্রাপ্তির জন্য ঢাকার প্রচেষ্টার প্রতি মালয়েশিয়ার সমর্থন এখনও অস্পষ্ট।

লিউ বলেন, আলোচনায় সময় লাগবে। মালয়েশিয়া এখনও চলতি বছরের আসিয়ান এজেন্ডায় বাংলাদেশের সদস্যপদকে অগ্রাধিকার দেয়নি এবং শীঘ্রই ফিলিপাইনের কাছে সভাপতির আসন হস্তান্তর করবে। তিনি আরও বলেন, গত মার্চে বাংলাদেশ ফিলিপাইনের কাছেও সমর্থন চেয়েছিল, কিন্তু অগ্রগতি সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়নি।

ঢাকার ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ভিজিটিং স্কলার মোঃ ওবায়দুল্লাহ মনে করেন, মালয়েশিয়ার সমর্থন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে যেহেতু ১০টি সদস্য রাষ্ট্রকে এ ব্যাপারে একমত হতে হবে — সেক্ষেত্রে বিশেষ করে মিয়ানমারের কাছ থেকে সম্ভাব্য বাধা ও চ্যালেঞ্জ আসতে পারে।

এরপরও, ২০২৫ সালে মালয়েশিয়ার নেতৃত্ব ঢাকার জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এগিয়ে নিতে সেরা সুযোগ বলে তিনি মনে করেন। তবে, বাংলাদেশকে আসিয়ানের মৌলিক মূল্যবোধ যেমন, কারো অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা এবং আঞ্চলিক সংঘাত নিরসনের অঙ্গীকার পূরণের সক্ষমতা প্রমাণ করতে হবে।

বাংলাদেশের এই প্রচেষ্টার প্রতি মিয়ানমারের বিরোধিতা মূলত চলমান রোহিঙ্গা সংকটের কারণে। দেশটির রাখাইন রাজ্য থেকে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। এদের ফিরিয়ে নিতে ঢাকা বারবার আহ্বান জানানোর পরও ২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতা দখলকারী মিয়ানমারের জান্তা সরকার এ ব্যাপারে তেমন আগ্রহ দেখায়নি। সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে।

তবে বিশ্লেষকরা একমত যে আসিয়ানের সদস্যপদ পেলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে যথেষ্ট লাভবান হবে। এতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে তার বাণিজ্য ও সংযোগ বৃদ্ধি পাবে।

লিউ-এর মতে, বাংলাদেশের বিশাল দক্ষ ও ব্যয়-প্রতিযোগিতামূলক এসটিইএম (বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত) স্নাতক ও কর্মীবাহিনী আসিয়ানের মূল্য-শৃঙ্খলকে এগিয়ে নিতে এবং এ অঞ্চলের জনসংখ্যাগত ও দক্ষতার ঘাটতি দূর করতে পারে।

তিনি মনে করেন, এই রূপান্তর আঞ্চলিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং আসিয়ান জুড়ে বৃহত্তর উন্নয়ন সুযোগ তৈরি করতে পারে।

গতানুগতিক পশ্চিমা বাজারের বাইরে বাংলাদেশের রপ্তানি বৈচিত্র্য সৃষ্টির সুযোগ তুলে ধরেন ওবায়দুল্লাহ। তিনি আসিয়ানের ৪.৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনীতি এবং আঞ্চলিক ব্যাপক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বে একীভূত হওয়ার সুযোগ তুলে ধরেন। বিশেষ করে, ২০২৬ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ যখন স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদা থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং উত্তর আমেরিকায় রপ্তানি থেকে আয় ৭ থেকে ১৪ শতাংশ হ্রাস পাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ওবায়দুল্লাহ বলেন, আসিয়ান একটি বাফার হিসেবে কাজ করতে পারে। এই ব্লকে যোগ দিলে বাংলাদেশের রপ্তানি ১৭ শতাংশ বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।

একীভূতকরণ বাংলাদেশকে ইলেকট্রনিক্স, অটোমোটিভ এবং উন্নত উৎপাদন ক্ষেত্রে আঞ্চলিক সরবরাহ শৃঙ্খলে প্রবেশের সুযোগ করে দেবে এবং একই সাথে বড় আকারে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করবে।

মাতারবাড়ি – বাংলাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্র বন্দরটি আসিয়ান এবং দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাণিজ্য প্রবাহকে আরও সুগম করতে এবং মালাক্কা প্রণালীর মতো সংকীর্ণ সামুদ্রিক পথের  উপর নির্ভরতা কমাতে পারে।

ওবায়দুল্লাহ আরও বলেন, আসিয়ানের সদস্যপদ বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থানকে উন্নত করবে এবং ভারত ও চীনের মতো প্রধান আঞ্চলিক শক্তির উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা কমাবে।

সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট থেকে অনুবাদ মাসুম বিল্লাহ